মঙ্গলবার ৫ আগস্ট ২০২৫ - ১১:৪৫
সাইবার আসক্তি তরুণ সমাজ ও পরিবারের জন্য এক নতুন সংকট

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো বর্তমান যুগে বিনোদনের অন্যতম প্রধান উৎসে পরিণত হলেও, গণমাধ্যম ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—নিয়ন্ত্রণহীন সাইবার ব্যবহার, বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে, ভয়াবহ মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। 'সাইবার আসক্তি' এখন একটি দ্রুত বিস্তারমান বৈশ্বিক উদ্বেগ, যা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য, পারিবারিক সম্পর্ক ও একাডেমিক জীবনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: গণমাধ্যম ও যোগাযোগ বিষয়ক গবেষক মোহাম্মদ রেজা সালমানি বলেন, যেখানে সাইবার প্রযুক্তি একদিকে মানুষকে সংযুক্ত করছে, অন্যদিকে তা পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা ও সরাসরি মানবিক সম্পর্ককে দুর্বল করে দিচ্ছে। “সাইবার বিনোদন তখনই কল্যাণকর, যখন তা ব্যক্তি ও সাংস্কৃতিক বিকাশে সহায়তা করে। কিন্তু যখন তা নিছক সময় নষ্ট বা মানসিক বিমুখতায় রূপ নেয়, তখন তা ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।”

তিনি উল্লেখ করেন, পরিবারের সদস্যরা এখন আলাদা আলাদা স্ক্রিনে ডুবে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা কমিয়ে ফেলেছেন। শিশুদের ক্ষেত্রে এ বিচ্ছিন্নতা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। “সাইবারস্পেস তরুণদের মাঝে আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়াচ্ছে। অথচ যদি আমরা তা সচেতনভাবে ব্যবহার করি, তবে এটি হতে পারে মানবিক ঐক্য ও মূল্যবোধ বিকাশের মাধ্যম।”

শিক্ষা কর্মকর্তাদের উদ্বেগ
আমির তাজালিনিয়া, ইরানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা বিষয়ক মহাপরিচালক, বলেন, “বর্তমানে শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে সাইবার আসক্তি যদিও সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই, তবু এটা স্পষ্ট যে অধিকাংশ শিক্ষার্থী অতিরিক্ত সময় অনলাইনে কাটাচ্ছে।”

তিনি জানান, এর ফলে শুধু সময় নষ্টই হচ্ছে না, বরং শারীরিক জটিলতা—যেমন স্থূলতা, চোখের ক্ষতি, শরীরচর্চার অভাব—এবং মানসিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে। “ছাত্রছাত্রীদের সময় ব্যবস্থাপনার অভাব আজ শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রধান উদ্বেগে পরিণত হয়েছে। অনেক সময় ভার্চুয়াল জগতে ব্যয় হচ্ছে এমন কাজে, যার কোনো শিক্ষাগত বা মানসিক উপযোগিতা নেই।”

তিনি আরও সতর্ক করেন—অনেক শিশুই অনিয়ন্ত্রিত ও অগ্রহণযোগ্য কনটেন্টের সংস্পর্শে আসছে, যা তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উন্নত দেশগুলোতে যেভাবে শিশুদের অনলাইন কার্যক্রমে নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা রয়েছে, সে রকম উদ্যোগের অভাব রয়েছে আমাদের সমাজে।

নিষেধাজ্ঞা নয়, চাই সচেতনতা ও দিকনির্দেশনা
বিশেষজ্ঞরা একমত পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা কোনো কার্যকর সমাধান নয়। বরং সচেতনতা, সময়ানুবর্তিতা ও সৃজনশীল বিকল্প বিনোদনই প্রকৃত সমাধান।

তাজালিনিয়া বলেন, “আমাদের এমন কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত, যা শিশুদের আনন্দ, শরীরচর্চা, সৃজনশীলতা ও পরিবারকেন্দ্রিক সময় কাটানোর সুযোগ তৈরি করে। বাস্তব অভিজ্ঞতা ভার্চুয়াল দুনিয়ার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।”

তিনি অভিভাবক ও শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, শিশুদের জন্য স্পষ্ট ও কার্যকর ডিজিটাল নিয়মনীতি তৈরি করতে হবে, যেমন: শিক্ষকদের ২৪ ঘণ্টা মেসেজ দেওয়া কি গ্রহণযোগ্য?

শিশুরা কি অনলাইন গোপনীয়তা ও পরিচয় যাচাইয়ের গুরুত্ব বোঝে?

“ডিজিটাল সাক্ষরতা এখন পড়া-লেখার মতোই অপরিহার্য। শিশুদের শেখাতে হবে শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার নয়—সচেতন ও দায়িত্বশীল ব্যবহারের কৌশলও।”

ভারসাম্যই মূল চাবিকাঠি
আজকের আধুনিক সমাজে সাইবারজগৎ অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা হলেও, সেই জগত যেন আমাদের আত্মার বন্ধনকে না ছিন্ন করে—এই সতর্কতা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। “সাইবারস্পেসকে হোক জ্ঞানের বাহন ও সম্পর্কের সেতু—না যেন তা হয় নিঃসঙ্গতার গহ্বরে পতনের পথ।”

সাইবার জগৎ হোক বিকাশের হাতিয়ার, যে না হয় মূল্যবোধ হারানোর ফাঁদ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এখনই প্রয়োজন সচেতন দিকনির্দেশনা, সংলাপ, ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha